Top Maoist Leader Surrendered Before Government

বাণিজ্যে স্নাতক, দাদা কিষেণজির হাত ধরে মাওবাদী আদর্শে হাতেখড়ি, কে এই মাল্লুজোলা বেণুগোপাল ওরফে ভূপতি?

কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন কাগার’। দেশের মাটি থেকে মাওবাদী সন্ত্রাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মাল্লুজোলা বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতির আত্মসমর্পণ এই অভিযানের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। কেন্দ্র, রাজ্য সরকার ও নিরাপত্তাবাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় সাফল্যের প্রতীক হিসেবেই মনে করা হচ্ছে।

আত্মসমর্পণ করলেন মাওবাদী জঙ্গিনেতা ভূপতি।
ইন্দ্রজিৎ মল্লিক, কলকাতা
  • শেষ আপডেট:১৮ অক্টোবর ২০২৫ ১২:৫২

দেশকে ২০২৬ সালের ৩১শে মার্চের মধ্যে মাওবাদী জঙ্গিমুক্ত করার সংকল্প নিয়েছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। এই অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে শুরু হয়েছে এক নজিরবিহীন অভিযান। ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। আজ মাওবাদীদের জঙ্গি আন্দোলন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। বহু জঙ্গি নেতা ও সদস্য হয় নিহত হয়েছে, নয় আত্মসমর্পণ করেছে।

এ বার “লাল সন্ত্রাসমুক্ত ভারত”-এর পথে আরেক বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেশের সর্বাধিক ‘ওয়ান্টেড’ মাওবাদী জঙ্গি কমান্ডার মল্লুজোলা বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতি মহারাষ্ট্রের গডচিরৌলিতে আত্মসমর্পণ করেছে। বৃহস্পতিবার তাকে নিয়ে মোট ৬০ জন আত্মসমর্পণ করেছে। মাল্লুজোলা নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম শীর্ষ তিন নেতার মধ‍্যে একজন। ওই জঙ্গি সংগঠনের পলিটব্যুরোর সদস্যও ছিলেন।

মাওবাদী জঙ্গি ভূপতি বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল— সোনু, সোনু দাদা, বেণুগোপাল, অভয়, মাস্টার, বিবেক ও বেনু। ভূপতির মাথার ওপর ওড়িশা, মহারাষ্ট্র, ছত্তীসগঢ়, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্রপ্রদেশে এক কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৫ অক্টোবর মাল্লুজোলার আত্মসমর্পণের ছত্তীসগঢ়ে আরও ৭৮ জন মাওবাদী জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছে।

কে এই মাল্লুজোলা বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতি?

ভূপতি ১৯৫৬ সালের ১০ মে তেলেঙ্গানার করিমনগর জেলার পেদ্দাপল্লিতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। তার বাবা নাম মাল্লুজোলা বেঙ্কটাইয়া এবং মায়ের নাম মধুরাম্মা। মা মধুরাম্মা ২০২২ সালে এবং বেঙ্কটাইয়া ১৯৯৭ সালে মারা যান।

তিন ভাইয়ের মধ্যে ভূপতি ছিলেন কনিষ্ঠ। বড় ভাই মাল্লুজোলা কোটেশ্বর রাও, যে কিষেণজি নামেও পরিচিত ছিল।  ২০১১ সালে ২৪ নভেম্বর তদানীন্তন পশ্চিম মেদিনীপুরের লালগড়ে পুলিশের গুলিতে নিকেশ হয়। কিষেনজি ছিলেন মাওবাদী জঙ্গি সংগঠনের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা। দ্বিতীয় ভাই অঞ্জন্না এখনও মন্দিরের পুরোহিত হিসেবে কাজ করেন।

এই কিষেনজিই ছিলেন পিপলস ওয়ার গ্রুপ-এর প্রতিষ্ঠাতা। এই সংগঠনটি মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে ১৯৮০ সালে সিপিআই (মাওবাদী) গঠনে ভূমিকা নিয়েছিল। ভূপতি তারই দাদার পথ অনুসরণ করে মাওবাদী জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়।

মাল্লুজোলা বেণুগোপাল রাও কলেজে বাণিজ্য নিয়ে পড়াশুনার সময় থেকেই তিনি ‘র‍্যাডিকাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ ও ‘পিপলস ওয়ার গ্রুপ’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়। সেই সময় তারা অন্ধ্রপ্রদেশে বামপন্থী মতাদর্শ প্রচারে সক্রিয় ছিল। পড়াশুনার শেষে ভূপতি কিছু দিন অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের জনসংযোগ দফতরে চুক্তিভিত্তিক কর্মী হিসেবে কাজও করেন। পরে ভাই কিষেনজির পথেই চলে যায়। প্রায় ৪০ বছর ধরে সশস্ত্র জঙ্গি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন ভূপতি।

দক্ষ মাওবাদী প্রচারক হিসেবে ভূপতির উত্থান

ভূপতি পিপলস ওয়ার গ্রুপে যোগ দিতে বাড়ি-পরিবার ছেড়ে দেয়। এর পরেই দ্রুত সংগঠনের উচ্চস্তরে পৌঁছে যায়। ধীরে ধীরে ভূপতি তৃণমূল স্তরে লড়াই এবং মাওবাদের জঙ্গি মতাদর্শ প্রচারের নেতৃত্বে চলে আসেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের সুত্রের খবর, ভূপতি গডচিরোলী ও ছত্তীসগঢ়ের অবুজমাড় অঞ্চলে বেশি সক্রিয় ছিল।

ভূপতি সিপিআই (মাওবাদী)- জঙ্গি সংগঠনের দণ্ডকারণ্য অঞ্চলের বিশেষ আঞ্চলিক কমিটির প্রধান ছিল। এই জঙ্গি সংগঠনকে পশ্চিমঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত করতে বিশেষ ভূমিকা তারই ছিল বলে ধরা হয়। পরবর্তীকালে ভূপতিকে দলের কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশন ও পলিটব্যুরোর সদস্য করা হয়।

চেরুকুরি রাজকুমার ওরফে আজাদ নিকেশ হওয়ার পরে ভূপতি দলের মুখপাত্র হিসেবে “অভয়” ছদ্মনামে বিবৃতি প্রকাশ করত। ভূপতি দলের মতাদর্শ প্রচার কার্যক্রমের অন্যতম প্রধান মুখ ছিল। “জনতন্ত্র সরকার” নামে পরিচিত মাওবাদী প্রশাসনেরও তত্ত্বাবধানে ছিল ভূপতি।

ভূপতি দলের প্রচারপত্র, পুস্তিকা ও নীতিনির্দেশিকা লেখার মাধ্যমে গ্রামীণ এবং বিশেষ করে বনাঞ্চল এলাকায় মাওবাদীদের জঙ্গি মতাদর্শ ছড়িয়ে দেন। নতুন প্রজন্মের ক্যাডারদের মাওবাদী শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি সংগঠনের ঐক্য রক্ষায় কাজ করেছিল সে।

রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসে কী ভূমিকা?

ভূপতি পিপলস্ লিবারেশন গেরিলা সেনা (পিএলজিএ)-র কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনের প্রধান হিসেবে সরকার বিরোধী ‘গেরিলা যুদ্ধ’-এর কৌশল ঠিক করতেন। দিতেন হামলার অনুমোদনও। মহারাষ্ট্র, ছত্তীসগঢ়, তেলেঙ্গানা, ওড়িশা ও অন্ধ্রপ্রদেশে অসংখ্য যে হামলা হয়েছে, তা ভূপতির নির্দেশেই সংঘটিত হয়।

২০১১ সালের দান্তেওয়াড়ার চিন্তালনার মাওবাদী জঙ্গি হামলায় ৭৬ জন সিআরপিএফ জাওয়ান বীরগতি প্রাপ্ত হন। এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিল এই ভূপতি। জানা গিয়েছ, ভূপতি “অপারেশন গ্রিন হান্ট”-এর সময় পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী প্রতিরোধে নেতৃত্ব দেয়। মাওবাদী ‘জঙ্গি’ আন্দোলনের অন্যতম কৌশলগত মস্তিষ্ক হিসেবে বিবেচিত হন।

অস্ত্র পরিত্যাগ এবং আত্মসমর্পণ

গত সেপ্টেম্বর মাসে মাওবাদী জঙ্গিনেতা ভূপতি আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করে। গডচিরোলীর পুলিশের সঙ্গে মধ্যস্থতায় বসেন। আলোচনার পর ঠিক হয়, ১৩ অক্টোবর ভূপতি ও তার সঙ্গীরা ভামরাগঢ়ের হোদারি গ্রামের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। গড়চিরোলীর পুলিশ সুপার নিলৎপল এবং আইজি অপারেশন (নকশাল বিরোধী) সন্দীপ পাটিলের তত্ত্বাবধানে পুরো অভিযান সম্পন্ন হয়। রাতেই তাদের নিরাপদে গডচিরোলীতে আনা হয়। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবিশের উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করে মাওবাদী জঙ্গি নেতা মাল্লুজোলা বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতি।

ভূপতি আত্মসমর্পণের আগে এক চিঠিতে সহ-যোদ্ধাদের উদ্দেশে জানায়, “বর্তমান পরিস্থিতিতে সে আর সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যেতে পারবেন না।” ভূপতি স্বীকার করে নিয়েছে যে, দলের নেতৃত্বের বারংবার ভুল হয়েছে। সেই কারণে মাওবাদী আন্দোলন বিপর্যস্ত হয়েছে। সরকার এবং উন্নয়নের বিরোধীতা করে আন্দোলনের পথ বেছে নেওয়া যে সম্পূর্ণ ভুল ছিল, তা-ও ভূপতি মেনে নিয়েছে। ভূপতি লিখেছিলেন, “পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতি এবং প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রশাসনের অনুরোধ বিবেচনা করে আমরা অস্ত্র ত্যাগ করে মূলস্রোতে ফিরে আসতে প্রস্তুত।” 

প্রসঙ্গত, গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে ভূপতির স্ত্রী তারকা-সহ আরও ১০ জন মাওবাদী জঙ্গি মুখ্যমন্ত্রী ফডনবিশের উপস্থিতিতে আত্মসমর্পণ করেছিল।

‘অপারেশন কাগার’ এবং ‘লাল সন্ত্রাস’-এর অবসান

কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে ‘অপারেশন কাগার’। দেশের মাটি থেকে মাওবাদী সন্ত্রাসকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে। মাল্লুজোলা বেণুগোপাল রাও ওরফে ভূপতির আত্মসমর্পণ এই অভিযানের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। কেন্দ্র, রাজ্য সরকার ও নিরাপত্তাবাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় সাফল্যের প্রতীক হিসেবেই মনে করা হচ্ছে। উল্লেখ্য, ছত্তীসগঢ়ের অবুঝমাড়কে মাওবাদী জঙ্গিমুক্ত বলে ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।


Share