Dhanteras in Bengal

সুস্বাস্থ্যেই ধনপ্রাপ্তির চাবিকাঠি, সেই তত্ত্ব মেনেই বাঙালির জীবনে আসে ধনতেরাস

ধন্বন্তরির মাহাত্ম্য যাপনের আরও একটা অনুষঙ্গ না বুঝেই আমরা সঙ্গে নিয়ে চলেছি কতকাল ধরে। তা হল, পরেরদিনের সর্বরোগহর চোদ্দশাক ভোজন যা একান্তই বাঙালির নিজস্ব উৎসব। ধন্বন্তরির নামে কোনো কবিরাজ হয়তো বিধান দিয়েছিলেন কোনোকালে। আসলে ধনতেরস বা যমত্রয়োদশী যাই আপনি বলুন বা কেন, তা পালন করতে হয় ত্রয়োদশী তিথিযুক্ত সন্ধ্যায়। আর কে না জানে, আয়ুর্বেদ মতে রাতের বেলায় শাক খাওয়া বারণ? তাই ত্রয়োদশী তিথির সূর্যোদয় হলে পরের দিন আমরা ওল, পটল, বেতো, হিন্‌চে, পালং, পুঁই ইত্যাদি নানা শাকের সর্বরোগহর উৎকৃষ্ট পদ রান্না করি এবং আনন্দে খাই সুস্বাস্থ্যের কামনায়।

প্রতীকী চিত্র।
সুচেতা বন্দ্যোপাধ্যায়
  • শেষ আপডেট:১৭ অক্টোবর ২০২৫ ১১:৫১

বাঙালির জীবনে কতকিছুই তো বদলে গেছে। দুর্গাপুজো পার হলেই এখন যেমন ‘ধনতেরস’ এর বিজ্ঞাপনে গোটা কলকাতা ছেয়ে যায়, কোন গয়নার দোকানে সোনা কিনলে কত টাকা ছাড় পাওয়া যাচ্ছে, ধনতেরসে বাসন কেনা যাবে কিনা, নিদেনপক্ষে ঝাঁটা একটা কিনতেই হবে – এইসব আলোচনায় খবরের চ্যানেল-পোর্টাল, বাড়ির বৈঠকখানা সরগরম থাকে, আমাদের ছোটবেলায় এইসব ছিল না। ধনতেরসের কেনাকাটা নিয়ে বাঙালি মাথা ঘামাচ্ছে এই কুড়ি-পঁচিশ বছর হবে। 

উত্তর ভারত, পশ্চিম ভারতের ট্রেন্ডে গা ভাসানো বাঙালিদের দেখে ‘বিশুদ্ধ’ বাঙালিরা নাক সিঁটকাচ্ছে, বাংলা থেকে অবাঙালি তাড়াও, ফিরিয়ে দাও বাঙালিয়ানা গোছের আন্দোলন হচ্ছে, অতি-বাঙালি পুরাণবিদ ‘ধনতেরস’এর পৌরাণিক কাহিনী নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তাকে ‘ধনত্রাস’ বলে বাজার গরম করছেন আর তাই পড়ে বামপন্থী বাঙালি ‘ধনতেরস’ পালনকে ক্যাপিটালিজম-এর দাসত্ব বলে চায়ের কাপ আর সিগারেট হাতে গরম গরম আলোচনা করছে। মাঝখান থেকে ‘ধনতেরস’ কী এবং কেন, ধনই বা কী, তেরসই বা কী – সেসব আলোচনা গেছে হারিয়ে। অথচ একটু তলিয়ে দেখলে বোধ করি বোঝাও যেত যে, ব্যাপারটা খুব বেশি অবাঙালি নয়। আমাদের ছোটবেলার টুকিটাকি উপাদানে একে দিব্যি খুঁজে পাওয়া যাবে।     

আমাদের ছোটবেলাটা অন্যরকম ছিল। পুজোর পরে কার্তিক মাসে হালকা শিরশিরে ঠান্ডা পড়ে যেত, ফাঁকা রাস্তায়, নদীর ধারে বেশ শীত শীত করত। তখনও ক্যালোরি মেপে খাওয়ার বাড়াবাড়ি ছিল না, চায়ের কাপ থেকে দুধ চিনি বাদ পড়েনি, উৎসবে নেমন্তন্নে ডায়াবেটিসের পরোয়া না করে লোকে রসগোল্লা খেত প্রাণ ভরে। কিন্তু কার্তিকমাস পড়লেই বাড়ির বড়োদের মধ্যে একটা আলাদা সাবধানতা থাকত বাড়ির বাচ্চাদের আর বুড়োদের নিয়ে। 

দাদু-ঠাকুমাদের বয়সী মানুষজনের মুখে দুর্গাপুজো মিটতে না মিটতেই শোনা যেত – কার্তিকমাসে নাকি যমের চার দুয়ার খোলা থাকে। রোগে ভোগা বুড়ো মানুষরা নাকি কার্তিকমাস পড়লেই টপাটপ মরে যায়, জোয়ান ছেলেমেয়ে আর ছোট বাচ্চারাও একটু এদিক ওদিক হলেই অসুখে পড়ে। তাই সাবধানে থাকতে হবে খুব, খাওয়াদাওয়া সব পুষ্টিকর হতে হবে, সন্ধ্যাবেলায় রাস্তায় বেরোলে একটা হালকা গরম জামা সঙ্গে থাকা চাই, বিশেষ করে ছোট বাচ্চাদের। একেবারে ছোটবেলায় এইসব শুনতাম আর জানতাম, আমার ঠান্ডা লাগুক বা না লাগুক, সন্ধ্যার পরে রাস্তায় বেরোলেই মাথা-কান-গলা ঢাকা একটা টুপি পরতেই হবে আমাকে, ঠান্ডা কিছু খাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।

বিজয়া-লক্ষ্মীপুজোর পরও যে নাড়ু-নিমকি বানিয়ে রাখা হতো কাচের হরলিক্সের শিশি ভর্তি করে, সেগুলোও যদি এই ছুতোয় না দিয়ে বড়রা খেয়ে নেয় সব – সেই ভয়ে সুযোগ মতো চুরি করে মুখে পুরে দিতাম। ধরা পড়লেই চিৎকার – এভাবে অসময়ে এসব খাস না, পেট গরম হবে।

একটু বড় হয়ে একটু জ্ঞান-বুদ্ধি হল, বুঝলাম গরম আর বর্ষাকাল কেটে গিয়ে একটু একটু করে যখন ঠান্ডা পড়তে শুরু করে, তখন season change এর অসুখ বেড়ে যায় খুব। বর্ষাকালীন অসুখবিসুখ তখনও থেকে যায় কিছু, সেই সঙ্গে যোগ হয় হঠাৎ করে ঠান্ডা লেগে যাওয়া, একটু উলটোপালটা খেলেই পেটের গোলমাল তার উপর উৎসবের দিনগুলোতে যেহেতু গুরুপাক খাওয়াদাওয়া হতোই, তাই বাকি দিনগুলোর ‘ডায়েট’ বাড়ির গৃহিণীরা যথাসম্ভব স্বাস্থ্যকর এবং হালকা রাখার চেষ্টা করতেন তখনকার দিনের বোধবুদ্ধি অনুযায়ী।

যমের বাড়ির খোলা চার দুয়ার আর কার্তিকমাস জুড়ে অসুখ-বালাই-মরণের হাতছানি বাঙালির ওরাল ট্র্যাডিশনে বোধ করি বহু বছর ধরে ছিল। আর এটাই ধনতেরসের পৌরাণিক কথার বা লোকভাবনার সব থেকে কাছাকাছি। কার্তিক মাসে যম এবং আমাদের পিতৃপুরুষরা বোধকরি সেই খোলা চার দুয়ার দিয়ে কিঞ্চিৎ বের হয়ে আসেন আমাদের মর্ত্যের মানুষদের দেখতে। আর আসবেন নাই বা কেন, তার মাত্র পনেরদিন আগেই আশ্বিনে গোটা পিতৃপক্ষ জুড়ে এঁদের উদ্দেশে শ্রাদ্ধ-তর্পণ করা হয়েছে, পুত্রপৌত্রদের হাতে জলগণ্ডূষ পেয়ে তাঁদের সারা বছরের ক্ষুধা তৃষ্ণা মিটেছে, এ অবস্থায় তাঁদেরও আমাদের কথা হয়তো মনে পড়ে খুব। 

আমাদের পুরাণগুলি বিশেষত স্কন্দপুরাণ তার দীর্ঘ বিবরণে কার্তিকমাসের কৃষ্ণপক্ষের মাহাত্ম্য জুড়ে স্থান দিয়েছে আমাদের প্রেতলোকনিবাসী স্বজনদের আর মৃত্যুর দেবতা স্বয়ং যমরাজকে। মানুষ আর দেবতারা কার্তিকমাসে শ্রীলক্ষ্মীর আরাধনা করে অক্ষয় সম্পদলাভের জন্য, প্রদীপ জ্বালিয়ে সমস্ত জনপদ আলোকিত করে। কিন্তু এইসময়েও আমাদের প্রেতলোকের আত্মীয়রা অন্ধকারে থাকেন, যমপুরীর অন্ধকার দূর করতে তাঁদের এবং যমরাজের স্মরণে আমাদেরই প্রদীপ জ্বালাতে হবে সারা মাস জুড়ে। তাতে পূর্বপুরুষরাও প্রসন্ন হবেন, আর যমও খুশি হয়ে অকাল মৃত্যু, অপঘাত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করবেন আমাদের। 

পুরাণের এইসব গল্প সবাই নাও জানতে পারেন কিন্তু এইসব আচার আমাদের বাংলাতেও ছিল। কার্তিকমাস পড়লেই আগে দেবতার আর পূর্বপুরুষের নামে ‘আকাশপ্রদীপ’ জ্বালানো হত, একটা উঁচু বাঁশের আগায় একটা টিমটিমে আলো বাড়ির ছাদে জ্বালিয়ে রাখা হতো সারা রাত জুড়ে। এইসব পৌরাণিক কাহিনীর মধ্যেই যম দেবতার জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ তিথি হয়ে উঠেছে কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী, স্কন্দপুরাণ যাকে যম ত্রয়োদশী বলেছে –

কার্তিকস্যাসিতে পক্ষে ত্রয়োদশ্যাং নিশামুখে। 

যমদীপং বহির্দদ্যাৎ অপমৃত্যুর্বিনশ্যতি।।

কাহিনী আছে – একসময় হেমনক নামে এক বালক এইরকম দীপদানের ফলেই নাকি অপঘাত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেছিল যমের কৃপায়। যম স্বয়ং নাকি যমদূতদের আদেশ করেছিলেন – কার্তিকের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে আমার নামে যারা দীপ জ্বালাবে, তাদের অপমৃত্যুর সম্ভাবনা থাকলেও তোমরা নিয়ে এসো না যেন। শুধু তাই নয়, যমের কৃপায় যমের অধীনে যে নরক আছে সেখানেও মানুষকে বাস করতে হয়না এই তিথিতে দীপ জ্বালালে। যম আর পূর্বপুরুষের নামে দীপ জ্বালানোর এই উৎসব পরের দিন পর্যন্ত চলে, পুরাণমতে সেদিন পালিত হয় প্রেতচতুর্দশী বা নরক চতুর্দশী, আমাদের বাংলায় ভূতচতুর্দশী। 

এবার ধনতেরসের কথায় আসি। ধনতেরসের ‘ধন’ শব্দের মানে কিন্তু টাকাপয়সা নয়, এ হল বৈদ্যরাজ ধন্বন্তরির নামসংক্ষেপ। পুরাণের বিবরণ অনুযায়ী সমুদ্রমন্থনের ফলে সম্পদের দেবী লক্ষ্মী উঠে আসার আগে অমৃতের কলস হাতে উঠে এসেছিলেন ধন্বন্তরি। দেবতাদের অমৃতপান, অমৃতের কলসের সুরক্ষার ব্যবস্থা সব মিটে যাওয়ার পর এই ধন্বন্তরি নারায়ণ-বিষ্ণুকে বললেন – প্রভু! এবার আমাকে দেবলোকে স্থান দিন। বিষ্ণু বললেন – তা তো এখন সম্ভব নয়, এখন তোমাকে মর্ত্যলোকেই বাস করতে হবে কিছুকাল। কাশীর রাজা দীর্ঘতমার পুত্র হয়ে তুমি জন্মাবে এবং মর্ত্যে আয়ুর্বেদশাস্ত্রের প্রণয়ন করবে। মর্ত্যের চিকিৎসাব্যবস্থার আমূল সংস্কারের পর মৃত্যু হলে তুমি দেবলোকে এসে নিজের স্থান গ্রহণ কোরো। 

আমরা বাঙালিরা বিধানচন্দ্র রায়কে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পেয়ে কতখানি আনন্দ পেয়েছিলাম, ধন্বন্তরি ডাক্তার বলে তাঁর সম্পর্কে লোকে এখনও শতমুখে কত গল্প করে। আর সেখানে কাশী স্বয়ং আয়ুর্বেদের জন্মদাতা ধন্বন্তরিকে রাজা হিসেবে পেয়েছিল সেই কোনকালে। জীবিত অবস্থাতেই অমৃতের কারিগর ধন্বন্তরি মর্ত্যের মানুষের ভগবান হয়ে উঠেছিলেন হয়তো। সমুদ্রমন্থনের কাহিনী স্মরণ করে লক্ষ্মীর আবির্ভাবের দুই দিন আগে হয়তো তারাই ভালোবেসে ধন্বন্তরির পুজো করে থাকবে। তারপর সেই পুজো ছড়িয়ে পড়ে থাকবে সারা দেশে। এক প্রবীণ অধ্যাপক সেদিন খবর দিলেন – আমাদের এই বাংলাতেও বৈদ্য-কবিরাজরা এই তিথিতে ধন্বন্তরির পুজো করতেন এই কিছুদিন আগেও। 

আজকাল সেই কবিরাজরা সংখ্যায় কমে আসছেন, আর মেডিকেল কলেজে ধন্বন্তরির নাম করলে শিক্ষায় গৈরিকীকরণ হচ্ছে বলে গেল গেল রব উঠবে। তাই ধন্বন্তরির পুজো হারিয়ে গিয়ে এই তিথির উদযাপন বদলে গিয়েছে, দীপাবলীর আর তার পরদিনে বিক্রম সম্বতের নববর্ষের জন্য কেনাকাটা, ‘সেল’এর দিন হয়ে উঠেছে ব্যবসায়ীদের কল্যাণে। কারণ বিক্রম সম্বতের হিসেবে এইদিনেই ব্যবসায়িক, আর্থিক বর্ষশেষ হয় একপ্রকার। সুতরাং আমাদের বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসেবে চৈত্র সংক্রান্তি আর চৈত্রসেলের যা মাহাত্ম্য, বিক্রম সম্বত অনুসারীদের কাছে তাই ধনতেরস। ধন্বন্তরির নামসংক্ষেপ টাকাপয়সার পরিসরে আটকা পড়েছে শেষ পর্যন্ত।  

আসলে মৃত্যুভয়ে যমের উদ্দেশে দীপ জ্বালিয়ে, যমের পুজো করেও মানুষ শেষমেশ জীবনের আর সুস্বাস্থ্যের আরাধনা করতেই চায়। তাই মৃত্যুর দেবতার দিনেই সুস্বাস্থ্যের দেবতা, চিকিৎসার দেবতারও পুজো হবে, তাও আবার সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনার প্রাক্কালে – এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। সেই কোন ছোটবেলা থেকেই তো আমরা শুনে আসছি যে, স্বাস্থ্যই হল সবথেকে বড় সম্পদ! কাজেই ধনতেরস বাংলায় ছিল না বলি কেমন করে? কোনওভাবেই না বুঝে একে ‘ধনত্রাস’ বলে দেগে দিয়ে গেল গেল রব তোলা চলে না। 

ধন্বন্তরির মাহাত্ম্য যাপনের আরও একটা অনুষঙ্গ না বুঝেই আমরা সঙ্গে নিয়ে চলেছি কতকাল ধরে। তা হল, পরেরদিনের সর্বরোগহর চোদ্দশাক ভোজন যা একান্তই বাঙালির নিজস্ব উৎসব। ধন্বন্তরির নামে কোনো কবিরাজ হয়তো বিধান দিয়েছিলেন কোনোকালে। আসলে ধনতেরস বা যমত্রয়োদশী যাই আপনি বলুন বা কেন, তা পালন করতে হয় ত্রয়োদশী তিথিযুক্ত সন্ধ্যায়। আর কে না জানে, আয়ুর্বেদ মতে রাতের বেলায় শাক খাওয়া বারণ? 

তাই ত্রয়োদশী তিথির সূর্যোদয় হলে পরের দিন আমরা ওল, পটল, বেতো, হিন্‌চে, পালং, পুঁই ইত্যাদি নানা শাকের সর্বরোগহর উৎকৃষ্ট পদ রান্না করি এবং আনন্দে খাই সুস্বাস্থ্যের কামনায়। শাকের সংখ্যা কমে বারো হোক বা বেড়ে আঠেরো, বলে যাই, এর সঙ্গে কিন্তু চতুর্দশীতে ভূতে ধরার কোনো সম্পর্ক নেই!

লেখিকা পুরাণ গবেষক।


Share