Kojagori Lakshmi Puja or Sharad Purnima

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো এবং বাঙালির ব্রতকথা (পর্ব ২)

মার্কণ্ডেয় পুরাণে পরব্রহ্মময়ী দেবীর সকল শক্তি যেমন এক এক দেবতার মধ্যে প্রকাশিত হতে দেখি, আবার অসুরদলনের জন্য দেবী মূর্তরূপে আবির্ভূত হলে সেই দেবতারা যেমন তাঁকে তাঁরই মহিমাযুক্ত ধনসম্পদ, অস্ত্রশক্তিতে সজ্জিত করে তোলেন – শতপথ ব্রাহ্মণের এই কাহিনীটিকে সেই পৌরাণিক কাহিনীর জননী বলা যেতে পারে। কিন্তু মূর্তিমতী দেবীরূপে কিংবা অমূর্ত রূপে শ্রী বা লক্ষ্মী বলতে ঠিক কোন বিষয়কে বোঝায় তার একটা সম্যক পরিচয় এই কাহিনী বুঝিয়ে দেয়।

বাঙালির ঘরে পূজিত দেবী লক্ষ্মী।
সুচেতা বন্দ্যোপাধ্যায়
  • শেষ আপডেট:০৬ অক্টোবর ২০২৫ ০৭:৪৪

শেষ পর্ব

বৈদিক যুগে শ্রী বা সমৃদ্ধি কোনো মূর্ত দেবী ছিলেন না। শ্রী ছিল একটা ‘কনসেপ্ট’, কিংবা বলতে পারেন সমৃদ্ধির পর্যায়বাচক শব্দ। শ্রী শব্দ ছিল সম্পদের প্রতীক, আধিপত্যের প্রতীক। বৈদিক দেবতাদের সম্পর্কে যেসব মন্ত্র ঋগ্বেদে উচ্চারিত হয়েছে, তার মধ্যে একটা কথা কিন্তু এই যে তাঁরা সকলেই শ্রী-যুক্ত অর্থাৎ সমৃদ্ধ এবং এই সমৃদ্ধি তাঁদের প্রসাদে তাঁদের ভক্তরাও লাভ করে থাকেন। 

বৈদিক দেবতা পূষণ, অশ্বিনীকুমার, অগ্নি সকলের সম্পর্কেই এই একই কথা থাকায় বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, সেকালে শ্রী লাভের জন্য শ্রীময়ী কোনো দেবীর পূজা হত না। বরং বৈদিক দেবতাদের উদ্দেশে যজ্ঞাহুতি দিলে দেবতার প্রসাদেই শ্রী বা সমৃদ্ধি লাভ করা যেত। যেমন শতপথ ব্রাহ্মণে এক গৃহস্থ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, যে তিনি তাঁর গার্হপত্য অগ্নিতে যত আহুতি দেবেন, ততই আরও বেশি করে গৃহের উপর তাঁর আধিপত্য তৈরি হবে, কেননা আধিপত্যই শ্রী – শ্রীর্বৈ গার্হপত্যম্‌। যাবত যাবত ইষ্টে তদেনম্‌ অগ্নিরে গৃহপতি গার্হপতমভি পরিণয়তি। এই যে গার্হস্থ্যের ক্ষুদ্র পরিসরে রাজকীয় আধিপত্য পাওয়া, এটাই শ্রীলাভ। 

তাহলে কি প্রাচীন গ্রন্থে দেবী লক্ষ্মীর কোনো অস্তিত্বই ছিল না? তেমন কিন্তু নয়। ওই একই শতপথ ব্রাহ্মণে একটা কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে, যাকে পরবর্তী সময়ে দেবী হিসেবে শ্রী বা লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠার আদি সূত্র বলা চলে। সেখানে দেখা যাচ্ছে – সৃষ্টির তপস্যায় রত ব্রহ্মার দেহ থেকে এক তেজোময়ী যুবতীর আবির্ভাব হচ্ছে এবং পৃথিবীর সকল শ্রী, সকল সম্পদ সেই নারীর মধ্যে অধিষ্ঠান করছে। 

দেবতারা তা দেখে সেই শ্রীদেবীকে বধ করে সেই সকল সম্পদ হরণের ভাবনা করতে লাগলেন। শেষে ব্রহ্মার উপদেশে তাঁকে প্রাণে না মেরে দেবতারা একে একে তাঁর সকল সম্পদ হরণ করলেন বলপ্রয়োগ করে। অগ্নি হরণ করলেন খাদ্য-অন্ন, বরুণ গ্রহণ করলেন সম্রাটের সার্বভৌমত্ব, মিত্র গ্রহণ করলেন ক্ষাত্র তেজ, ইন্দ্র নিলেন বল, বৃহস্পতি নিলেন লক্ষ্মীর প্রভা, সূর্য কেড়ে নিলেন রাষ্ট্রশক্তি, পূষা নিলেন সৌভাগ্য, সরস্বতী বা বাক্‌ নিলেন সমৃদ্ধি, পুষ্টি, যশ, আর ত্বষ্টা হরণ করলেন তাঁর মধুর রূপ। 

একজন নারীর উপর এতজন দেবদেবীর বলপ্রয়োগের মতো ধর্ষণপ্রায় ঘটনার পরও কিন্তু সেই নারী এতটুকু বিপর্যস্ত হননি। বরং আপন ব্যক্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করে তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মার সামনে এর প্রতিবাদ করেছেন। মূর্তিমতী শ্রীর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়ে ব্রহ্মা তাঁকে তাঁর সকল সম্পদ ফিরে পাওয়ার বর দিয়েছেন এবং দেবতাদের কাছ থেকে সকল সমৃদ্ধি পুনরায় ফিরে পেয়ে সেই দেবী প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সম্পদের দেবীরূপে। 

নারীর উপর বলপ্রয়োগের ঘটনাটিকে পরিমার্জন করলে মার্কণ্ডেয় পুরাণে পরব্রহ্মময়ী দেবীর সকল শক্তি যেমন এক এক দেবতার মধ্যে প্রকাশিত হতে দেখি, আবার অসুরদলনের জন্য দেবী মূর্তরূপে আবির্ভূত হলে সেই দেবতারা যেমন তাঁকে তাঁরই মহিমাযুক্ত ধনসম্পদ, অস্ত্রশক্তিতে সজ্জিত করে তোলেন – শতপথ ব্রাহ্মণের এই কাহিনীটিকে সেই পৌরাণিক কাহিনীর জননী বলা যেতে পারে। কিন্তু মূর্তিমতী দেবীরূপে কিংবা অমূর্ত রূপে শ্রী বা লক্ষ্মী বলতে ঠিক কোন কোন বিষয়কে বোঝায় তার একটা সম্যক পরিচয় এই কাহিনী বুঝিয়ে দেয় আমাদের। 

তবে একথা বোধহয় সেই প্রাচীন কাল থেকেই সত্য যে, সমৃদ্ধি কাকে বলে তা অভাব বা শ্রীহীন অবস্থা চোখে না দেখলে স্বাভাবিক জীবনে মানুষ গুরুত্ব দিয়ে অনুধাবন করে না। আমার ঠাকুমার পাঁচালীর সেই বণিকের ‘যাহার অভাব আছে সে পূজে উহারে’ গর্বোক্তি আজকের দিনে যতখানি সত্য, পুরাণের কালেও ততখানিই সত্য ছিল। এই অভাব আক্ষরিক অর্থেই অভাব হতে পারে, অভাবের আতঙ্ক হতে পারে কিংবা হতে পারে অন্য কোনো অধিক সম্পদশালী মানুষকে দেখে ঈর্ষার বশে তৈরি হওয়া অভাববোধ। 

পুরাণে দেবী লক্ষ্মীর যে জন্মকথা পাওয়া যায় তাতেই সেটা বেশ ভালো বোঝা যাবে। শ্রী বা লক্ষ্মী যে সমুদ্রের কন্যা এবং সমুদ্রমন্থনের সময় উঠে এসেছিলেন, এব্যাপারে প্রায় সব পুরাণই একমত। বিষ্ণুপুরাণে যে কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে সেটা এইরকম – স্বর্গের অধিপতি ইন্দ্র একসময় তাঁর প্রিয় হাতিটিতে চড়ে বনভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সেখানে উপস্থিত হলেন ঋষি দুর্বাসা, হাতে তাঁর দিব্য এক পুষ্পমালা। সেই মালা দুর্বাসা ইন্দ্রকে উপহার দিলেন। ইন্দ্র তা গ্রহণ করলেন ঠিকই, কিন্তু ঐশ্বর্যের অহংকারে তিনি এতটাই মত্ত ছিলেন, যে দুর্বাসার মতো মহান ঋষিকে সম্মান দেখানোর কথা তাঁর মনে রইল না। ফুলের মালাটিও তিনি অবহেলায় পরিয়ে দিলেন হাতির গলায়। আর হাতিটি সেই ফুলের তীব্র গন্ধ সহ্য করতে না পেরে মালা ছুঁড়ে ফেলল মাটিতে। ইন্দ্রের এই অপমানজনক আচরণে দুর্বাসা এমনই ক্রুদ্ধ হলেন যে তিনি ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন, যার প্রভাবে দেবলোকের শ্রী-ঐশ্বর্য ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে গেল, স্বর্গে-মর্ত্যে অলক্ষ্মীর ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। 

সর্বত্র বিনাশের চিহ্ন ফুটে উঠল, দানধর্ম, যাগযজ্ঞ বন্ধ হল, মানুষের মধ্যে সত্ত্বগুণ বলে আর কিছু অবশিষ্ট রইল না। এই সুযোগে অসুররা স্বর্গলোক অধিকার করে নিল। দেবতারা সকল সম্পদ হারিয়ে অসহায় হয়ে ব্রহ্মা-বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন শেষ পর্যন্ত আর তাঁদের পরামর্শেই শ্রী পুনরুদ্ধারের আশায় সমুদ্রমন্থন আরম্ভ হল অসুরদের সঙ্গে নিয়ে। সেই সমুদ্রমন্থনের ফলে বহু সম্পদ উঠে এলো, এলো চন্দ্র, পারিজাত ফুল, ঐরাবত হস্তী, উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব, অমৃতের কলস হাতে এলেন ধন্বন্তরি, এবং অবশেষে লক্ষ্মী। তিনি নারায়ণের গলায় বরমাল্য দিয়ে বৈকুণ্ঠে প্রতিষ্ঠিত হলেন, স্বর্গে-মর্ত্যে পূজিত হলেন সম্পদের দেবীরূপে, তিন ভুবনে শ্রী ফিরে এলো আবার। 

কোনও কোনও পুরাণে এই কাহিনীতে সমুদ্র থেকে লক্ষ্মীর আগে কুরূপা-বৃদ্ধা-জরাগ্রস্তা অলক্ষ্মীর আবির্ভাবের উল্লেখও মেলে। এই অলক্ষ্মী লক্ষ্মীর জ্যেষ্ঠা ভগ্নী, শ্রীহীনতার মূর্ত রূপ। তাই বলছিলাম, অলক্ষ্মীকে অনুভব করতে না পারলে মানুষের উদ্যম নষ্ট হয়, সম্পদের গুরুত্ব বোঝার শক্তি হারিয়ে যায়, লক্ষ্মীকে আমরা অবহেলা করতে শুরু করি। শ্রীহীনতা, দরিদ্রতা আমাদের প্রথমে নিরাশ হতাশ করে তুলেও শেষ পর্যন্ত পুনরায় শ্রীলাভে উদ্যোগী করে তোলে, দরিদ্রতা আমাদের সম্পদের গুরুত্ব বোঝায়, লক্ষ্মীর আরাধনার প্রেরণা দেয়। 

ঠিক যেমনটি দেবতাদের সঙ্গে না ঘটলে দেবতারা হয়তো সমুদ্রমন্থনের চেষ্টাই করতেন না কোনও দিন, ঠিক যেমন পাশায় হেরে সর্বস্বান্ত হয়ে বনে না গেলে যুদ্ধজয়ের ভাবনা আসত না যুধিষ্ঠিরের মতো ঋষিতুল্য শান্ত মানুষের মনে, তেমনই আমার ঠাকুমার লক্ষ্মী পাঁচালীর বণিকটিও সপ্তডিঙ্গা না ডুবলে বোধহয় বুঝতেই পারতেন না যে, যে সম্পদ ফেলে ছড়িয়ে অবহেলায় নষ্ট করছে তার গুরুত্ব কতখানি। সেই বোধ, সেই উদ্যমই বোধহয় শেষ পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্মীছাড়া থেকে লক্ষ্মীমন্ত করে তোলে।ফলে অলক্ষ্মীকে যতই দুষ্ট ভাবি, অলক্ষ্মীর আবির্ভাব কিংবা আবির্ভাবের আতঙ্কই আমাদের লক্ষ্মীলাভের উদ্যম নষ্ট হতে দেয় না শেষ পর্যন্ত। 

কাজেই লক্ষ্মীর প্রতিষ্ঠায় অলক্ষ্মীর গুরুত্ব বড় কম নয়। তাই বোধহয় অথর্ববেদও লক্ষ্মীকে পুণ্যলক্ষ্মী বলে অলক্ষ্মীকেও ‘পাপলক্ষ্মী বা দুষ্টলক্ষ্মী’ বলেছে কিন্তু সম্মান দিয়েছে লক্ষ্মীর সমতায়। লক্ষ্মীর পৌরাণিক কাহিনী আর আমার ঠাকুমার আমলের পাঁচালীর ভাব, বোধ, মনস্তত্ত্ব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় শেষ পর্যন্ত। 

আমার ঠাকুমার আমলের লক্ষ্মীর পাঁচালীটি আমাকে ভাবায় আরও একটা কারণে। এটি যখন লেখা হয়েছিল, দেশ তখনও স্বাধীন হয়নি, দেশভাগও হয়নি, তবে বিশ্বযুদ্ধের সময় যে দুর্ভিক্ষ বাংলার মানুষ দেখেছে তার ক্ষত তখনও দগদগে। নারদমুনি মালক্ষ্মীকে মর্ত্যের যন্ত্রণা শুনিয়ে বলছেন --  

সতত কু-ক্রিয়ারত নরনারীগণ।
অসহ্য যাতনা দেয় দুর্ভিক্ষ ভীষণ।।
অন্নাভাবে শীর্ণকায় বলহীন দেহ।
অতিকষ্টে আত্মহত্যা করিতেছে কেহ।।
প্রাণের অধিক কেহ পুত্রকন্যাগণে।
পরিত্যাগ করিতেছে অন্নেরই কারণে।।

লক্ষ্মীব্রতের প্রচার করতে মর্ত্যে আসা লক্ষ্মীর মুখে সেই সময়ের ঘরণী গৃহিণীদের জন্য কিছু মেয়েলি সমাধান লিখেছেন আমাদের সেই বরিশালনিবাসী ব্রাহ্মণ কথক –

লক্ষ্মীর ভাণ্ডার স্থাপি সব ঘরে ঘরে।
রাখিবে তণ্ডুল তাহে একমুষ্টি করে।।
সঞ্চয়ের পথ ইহা জানিবে সকলে।
অসময়ে উপকার পাবে এর ফলে।।
আলস্য ত্যজিয়া সূতা কাটো বামাগণ।
দেশের অবস্থা মনে করিয়া চিন্তন।।

পরবর্তীতে লেখা, বিশেষ করে এখন যেসব পাঁচালী কিনতে পাওয়া যায়, সেখানে আজকের গৃহবধূদের জন্য এমনকী কর্মজীবী মহিলাদের জন্যও কোনো সময়োপযোগী উপদেশ দেখি না। উপাখ্যানটুকুই সার। আজকের তারিখে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ শব্দবন্ধ যে মহিলাদের একাংশের কাছে সঞ্চয়ের বদলে হাতখরচের অর্থ প্রতিষ্ঠা করছে, ক্ষুদ্র কর্মোদ্যোগ নষ্ট হতে বসেছে, আজকের বাংলা যে কর্মোদ্যমের অভাবে ধুঁকছে, একথা অরাজনৈতিক ভাবে বলার জন্য আজ কোনও পাঁচালীলেখক বোধহয় এই বাংলায় অবশিষ্ট নেই। নেই পাঁচালী শোনার জন্য আগ্রহী গৃহবধূর দলও। 

মার্কণ্ডেয় পুরাণে পরব্রহ্মময়ী দেবীর সকল শক্তি যেমন এক এক দেবতার মধ্যে প্রকাশিত হতে দেখি, আবার অসুরদলনের জন্য দেবী মূর্তরূপে আবির্ভূত হলে সেই দেবতারা যেমন তাঁকে তাঁরই মহিমাযুক্ত ধনসম্পদ, অস্ত্রশক্তিতে সজ্জিত করে তোলেন – শতপথ ব্রাহ্মণের এই কাহিনীটিকে সেই পৌরাণিক কাহিনীর জননী বলা যেতে পারে। কিন্তু মূর্তিমতী দেবীরূপে কিংবা অমূর্ত রূপে শ্রী বা লক্ষ্মী বলতে ঠিক কোন কোন বিষয়কে বোঝায় তার একটা সম্যক পরিচয় এই কাহিনী বুঝিয়ে দেয়। 

যাই হোক, অবশেষে এ বছরের মতো ভোগের খিচুড়ি, পায়েস, ধান-কড়িতে ভরা বেতের ঝাঁপি আর পাঁচালীর সুর নিয়ে লক্ষ্মীপুজো এসে গিয়েছে। মা লক্ষ্মী এসে বসবেন আমাদের দরিদ্র অর্থনীতির এই বাংলার ঘরে ঘরে, দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জনের পর শ্রীহীন অন্ধকার মণ্ডপে মণ্ডপে। এতক্ষণের লক্ষ্মীচর্চায় এটুকু বোধহয় আপনাদের বোঝাতে পেরেছি যে লক্ষ্মী আরাধনার জন্য তিথিবিশেষের প্রয়োজন নেই, এ এক নিরন্তর সাধনার, তপস্যার বিষয়। 

তবু কোজাগরী পূর্ণিমা যেহেতু বাংলা ছাড়াও সারা দেশেই নানা ভাবে পালিত হয় আর এই তিথির সঙ্গে শ্রীসম্পদের দেবীর যোগ আছেই, তাই সবশেষে কোজাগরী পূর্ণিমা সম্পর্কে অল্প দু’চার কথা বলি। নারদ পুরাণ একে কোজাগর ব্রত বলেছে – আশ্বিনে মাসি পূর্ণায়াং ব্রতং কোজাগরাভিধম্‌। এইদিন সকালে স্নান এবং উপবাস করে বিধিমতে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করতে হয়, দেবী লক্ষ্মীর স্বর্ণনির্মিত অথবা মৃন্ময়ী মূর্তি এবং তাম্রঘট স্থাপন করতে হয় এই দিনে— 

লক্ষ্মীমভ্যর্চ্য সৌবর্ণিং ঘটে সংস্থাপ্য তাম্রজে।
মৃন্ময়ে বা সবস্ত্রান্তামুপচারৈঃ পৃথগ্‌বিধম্‌।। 

এই কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে ঘৃতশর্করযুক্ত পায়েস রান্না করে পূর্ণচন্দ্রালোকে নিবেদন করে ব্রাহ্মণভোজন করাবার বিধানও নারদ পুরাণ দিয়েছে। নারদ পুরাণ জানিয়েছে সেই আমাদের সকলের জানা বিখ্যাত খবরটাও – এই রাতে দেবী লক্ষ্মী ঘরে ঘরে এসে জিজ্ঞাসা করেন – কে জেগে আছ? জাগরিত ব্যক্তিকে দান করেন অক্ষয় সম্পদ –

অস্যাং রাত্রৌ মহালক্ষ্মীবরাভয়করাম্বুজা।
নিশিথে চরতে লোকে কো জাগর্তি ধরাতলে।।

তবে সব থেকে ইন্টারেস্টিং বিষয় হল, এইদিন রাত্রে চন্দ্রোদয়ের পর সোনার, রুপোর বা মাটির তৈরি লক্ষ লক্ষ ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালাতে বলা হয়েছে ঘরে ঘরে, ছোট গৃহস্থের বাড়িতেও নিদেনপক্ষে একশটা প্রদীপ জ্বালানোর পরামর্শ দিয়েছে নারদ পুরাণ যা আমাদের দীপাবলীর কথা মনে করায় –

ততঃ সায়ন্তনে কালে’ভ্যুদিতে তারকাধিপে।হৈমান্‌রৌপ্যান্‌মৃন্ময়ান্‌ বা ঘৃতপূর্ণান্‌ প্রদীপয়েৎ। 
লক্ষং তদর্ধমযুতং সহস্রং শতমেব বা।। 

আর এই দীপাবলী পালনের প্রথা লক্ষ্য করেই মহামতি পাণ্ডুরঙ্গ বামন কানে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ History of Dharmashastra-তে উল্লেখ করেছেন, চান্দ্র পঞ্জিকা মতে পূর্ণিমা তিথিতেই যেহেতু আশ্বিন শেষ হয়ে কার্তিক মাস আরম্ভ হয়ে যায়, সেহেতু কার্তিক মাসের দীপাবলী পালন বা দীপদান ব্রতও এইদিন থেকেই শুরু হয়ে যায়। কার্তিকের অমাবস্যা তিথিতে যে লক্ষ্মীপূজা হয়, সেই পূজার প্রারম্ভিক উৎসবও তাই কোজাগর পূর্ণিমা থেকেই শুরু হয়ে যায়। তবে কোজাগর শব্দটিকে তিনি ‘কৌমুদী জাগরণ’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ বলেছেন । আসলে কার্তিক মাসেরই অপর নাম কৌমুদ মাস আর গোটা মাস জুড়ে শ্রীসম্পদ লাভের জন্য পালনীয় কৌমুদব্রতের সূচনাও আশ্বিনের শেষ তিথি থেকেই হয়ে যায় বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। 

আমরা আমাদের সকলের, সকল পশ্চিমবঙ্গবাসীর, এবং সকল দেশবাসীর শ্রীসমৃদ্ধি কামনা করে আমাদের শ্রীশ্রীলক্ষ্মীমাহাত্ম্যচর্চা এখানেই শেষ করলাম। সকলের হৃদয়াসনে কমলাসনার আবির্ভাব হোক। 

লক্ষ্মীর ব্রতের কথা হল সমাপন।
ভক্তিভরে বর চাও যার যাহা মন।।
প্রণমামি লক্ষ্মীদেবী বিপদনাশিনী।
ক্ষীরোদসম্ভবা দেবী জগন্মোহিনী।।

(সমাপ্ত)


লেখিকা পুরাণ গবেষক


Share