Bolla Puja

শতাব্দী প্রাচীন বোল্লা রক্ষাকালী পুজোয় উপচে পড়া ভক্তসমাগম, উৎসবে মাতোয়ারা দক্ষিণ দিনাজপুর

দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের কাছে বোল্লা গ্রামে মহাসমারোহে সম্পন্ন হল শতাব্দী প্রাচীন বোল্লা রক্ষাকালী পুজো। রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার থেকে চার দিন ধরে চলে এই উৎসব। হাজারো ভক্ত ও দর্শনার্থীতে মুখরিত ছিল এলাকা। আদালতের নির্দেশ মেনে সীমিত বলি হলেও উৎসবের ভক্তি, ঐতিহ্য ও আনন্দে ভরপুর ছিল বোল্লা গ্রাম।

বালুরঘাটে বোল্লা রক্ষাকালী পুজো।
অরুণিমা কর্মকার, বালুরঘাট
  • শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৫ ০৭:০১

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের অদূরে বোল্লা গ্রামে প্রতিবছর আয়োজিত হয় উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী বোল্লা রক্ষাকালী পুজো। শতাব্দী প্রাচীন এই পুজোকে ঘিরে প্রতিবছর সৃষ্টি হয় এক অনন্য উৎসবমুখর পরিবেশ। রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার থেকে শুরু হয়ে চার দিন ধরে চলে এই উৎসব। শুধু দক্ষিণ দিনাজপুর নয়, উত্তর দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ এমনকি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ থেকেও হাজার হাজার ভক্ত ও দর্শনার্থী এই পুজোয় যোগ দিতে আসেন। প্রতিবছরের ন্যায় এ বারেও অন্যথা হয়নি এই পুজোর। মহাসমারোহে ধূমধাম করে শুক্রবার রাতে আয়োজিত হয় এই পুজো। 

উল্লেখ্য, বহু বছর আগে এক স্থানীয় মহিলা স্বপ্নাদেশে দেবীর নির্দেশ পান। সেই নির্দেশ অনুসারে একটি কালো পাথরের টুকরো উদ্ধার করা হয়, যা পরে বোল্লা রক্ষাকালী নামে পূজিত হতে থাকে। স্থানীয় জমিদার পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বর্তমান বোল্লা কালী মন্দির। দেবী এখানে ‘রক্ষা’র প্রতীক—তাঁকে গ্রাম ও মানুষের রক্ষাকারী হিসেবে মানা হয়। সেই বিশ্বাসই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই উৎসবকে জীবন্ত রেখেছে।

পুজোর সময় বোল্লা গ্রাম ও আশেপাশের এলাকা সেজে ওঠে আলোকসজ্জায়। চারপাশে শোনা যায় ঢাকের আওয়াজ। শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে বোল্লা গ্রাম। ভক্তরা দূরদূরান্ত থেকে এসে মায়ের আরাধনা করেন। মন্দির প্রাঙ্গণে প্রতিদিন চলে আরতি, যজ্ঞ ও ভক্তিমূলক সঙ্গীত। পুজোর অন্যতম আকর্ষণ ‘বাতাসা মেলা’। যেখানে বাতাসা, খেলনা, মৃৎশিল্প, এবং নানা গ্রামীণ দ্রব্য বিক্রির জন্য ভিড় জমায় হাজারো মানুষ। 

বোল্লা পুজো স্থানীয় শিল্পী ও কারিগরদের কাছেও এক বিশেষ সময়। প্রতি বছর পুজোর আগে থেকেই তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন হাজার হাজার ক্ষুদ্র মানতের প্রতিমা তৈরি করতে। ভক্তরা দেবীর উদ্দেশ্যে এই ক্ষুদ্র প্রতিমাগুলি নিবেদন করেন। এতে স্থানীয় মৃৎশিল্পীদের জীবিকায় নতুন প্রাণ সঞ্চার হয়। 

প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পুজো উপলক্ষে নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দর্শকদের জন্য ব্যবস্থা করা হয় পানীয়জল সহ প্রাথমিক চিকিৎসা শিবিরের। প্রতি বছর কয়েক লক্ষ মানুষের ভিড় সামাল দিতে পুলিশ, সিভিল ডিফেন্স ও স্বেচ্ছাসেবকরা একযোগে কাজ করেন এই মেলা প্রাঙ্গনে। 

তবে এই মেলায় প্রতিবছর বহু পাঠা বলি দেওয়া হয়। কিন্তু এবছর আদালতের নির্দেশ মেনেই বলি দেওয়া হয়েছে বোল্লা পুজোয়। কমিটির তরফ থেকে প্রশাসন সে বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিল। পাশাপাশি ভক্তরা বলি দেওয়ার যেসমস্ত পাঠা নিয়ে এসেছিলেন সেগুলোকে উৎসর্গ করে ছেড়ে দেওয়া হয়। 

বোল্লা রক্ষাকালী পুজো এখন কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি দক্ষিণ দিনাজপুরের সামাজিক ঐক্য, লোকসংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক গতির প্রতীক। 

আজও শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রেখে বোল্লা রক্ষাকালী পুজো উত্তরবঙ্গের সংস্কৃতিতে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। উৎসবের এই দিনগুলিতে বোল্লা গ্রাম যেন এক জীবন্ত মেলায় পরিণত হয়—যেখানে বিশ্বাস, ভক্তি, ঐতিহ্য আর আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।


Share