Myanmar military raids notorious KK park scam compound

থাইল্যান্ড সীমান্তে সাইবার জালিয়াতির ঘাঁটিতে মায়ানমার সেনাবাহিনীর অভিযান, আটক কয়েক হাজার কর্মী-প্রতারক

২০২০ সালের গোড়ার দিকে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণকারী জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এবং হংকংয়ের একটি স্বল্প পরিচিত তালিকাভুক্ত কোম্পানি হুয়ানিয়া ইন্টারন্যাশনালের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে তথ‍্যপ্রযুক্তির হাব হিসেবে কে কে পার্ক তৈরির কাজ শুরু হয়।

থাইল্যান্ডের দিক থেকে দেখা কে কে পার্কের অংশ।
ইন্দ্রজিৎ মল্লিক
  • শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৫ ০৩:১০

দীর্ঘদিন ধরেই মায়ানমারের বিদ্রোহী বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলেছে সাইবার জালিয়াতির কর্মকাণ্ড। ইলন মাস্কের স্টারলিংকের সংযোগ নিয়ে রমরমিয়ে চলেছে প্রতারণা কেন্দ্রগুলি। সর্বশান্ত হচ্ছেন বিশ্বজোড়া মানুষ। এ বার মায়নমার-থাইল্যান্ড সীমান্তের সবচেয়ে ‘কুখ্যাত সাইবার অপরাধ’ সংস্থাগুলির মধ্যে একটি দখল নিল সে দেশের সেনাবাহিনী। পাশাপাশি মায়ানমার সেনাবাহিনী জানিয়েছে, চলমান গৃহযুদ্ধে হারানো গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলও তারা পুনরুদ্ধার করেছে।

মায়ানমারের সীমান্তবর্তী শহর মায়াওয়াদ্দির দক্ষিণে থাই সীমান্তে অবস্থিত কে কে পার্ক গত পাঁচ বছর ধরে অনলাইন জালিয়াতি, অর্থ পাচার এবং মানব পাচারের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। হাজার হাজার মানুষকে ভালো বেতনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে এই জালিয়াতি সংস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিল এবং তারপরে বিশ্বজুড়ে সাধারণ মানুষের থেকে কোটি কোটি ডলার সাইবার অপরাধের মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার বিস্তৃত জালিয়াতি চক্র তৈরি করা হয়েছিল।

দীর্ঘদিন ধরে সাইবার জালিয়াতি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে ‘কলঙ্কিত’ মায়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে। এখন সেই সেনাবাহিনীই বলছে, থাইল্যান্ডের সঙ্গে প্রধান বাণিজ্য সংযোগ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত মায়াওয়াদ্দি শহরের চারপাশে নিয়ন্ত্রণ বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গেই তারা এই জালিয়াতি সংস্থাটি দখল করেছে। আগামী ডিসেম্বর মাসে মায়ানমারে নির্বাচন করাতে চাইছে সেনাবাহিনীর সরকার। সেই নির্বাচনের আগে সামরিক বাহিনী বেশ কয়েকটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিদ্রোহীদের ওই এলাকা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে অভ‍্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে বিধ্বস্ত দেশটি। এখনও দেশের বিশাল অংশ সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।  তার মধ্যেই দেশে নির্বাচন করাতে চাইছে সেনাবাহিনী। যদিও বিদ্রোহীরা এই নির্বাচনকে একটি প্রহসন বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের দখলে থাকা এলাকায় কোনও ভাবেই নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে সেনাবাহিনী। ২০২০ সালের গোড়ার দিকে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণকারী জাতিগত বিদ্রোহী গোষ্ঠী কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এবং হংকংয়ের একটি স্বল্প পরিচিত তালিকাভুক্ত কোম্পানি হুয়ানিয়া ইন্টারন্যাশনালের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে তথ‍্যপ্রযুক্তির হাব হিসেবে কে কে পার্ক তৈরির কাজ শুরু হয়। 

বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন, হংকংয়ের কোম্পানি হুয়ানিয়া ইন্টারন্যাশনালের সঙ্গে কুখ্যাত চিনা আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন ওয়ান কুওক কোই (যিনি ব্রোকেন টুথ নামে বেশি পরিচিত)-এর যোগসূত্র রয়েছে। ওই চিনা মাফিয়া তখন থেকেই সীমান্তে অন্যান্য সাইবার জালিয়াতি কেন্দ্রগুলিতেও বিনিয়োগ করেছে।

বিদ্রোহী বাহিনী নিয়ন্ত্রিত কে কে পার্ক তথ্যপ্রযুক্তি হাবটি দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে এবং সীমান্তে থাইল্যান্ডের দিক থেকে সহজেই দেখা যাচ্ছে। ওই তথ‍্যপ্রযুক্তি হাব থেকে যাঁরা কোনওভাবে পালাতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা সেখানে হাজার হাজার মানুষের ওপরে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এক নৃশংস শাসনের বর্ণনা দিয়েছেন। ওই কমপ্লেক্সে কাজ করা স্ক‍্যামস্টারদের অনেকেই আফ্রিকান দেশ থেকে এসেছিল। পালিয়ে আসার পর তাদের দাবি, সেখানে জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল। দীর্ঘ সময় ধরে তাদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হওয়া ব্যক্তিদের উপর নির্যাতন ও মারধর করা হত। 

মায়ানমারের সেনাবাহিনীর তথ্য মন্ত্রকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাহিনী কে কে পার্ককে ‘পরিষ্কার’ করেছে। সেখানকার প্রায় দু’হাজার জনের বেশি কর্মীকে মুক্তি দিয়েছে। ইলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট টার্মিনালের ৩০টি সংযোগ বাজেয়াপ্ত করেছে। থাই-মায়ানমার সীমান্তে অনলাইন কার্যকলাপের জন্য স্টারলিংক ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

ওই বিবৃতিতে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নকে ‘জঙ্গি’ সংগঠন হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে। সাইবার অপরাধের জন্য কেএনইউ এবং পিপলস ডিফেন্স ফোর্সকে দায়ী করা হয়েছে। মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে এই দুই সংগঠন। ওই এলাকাটি ‘অবৈধভাবে’ তারা দখল করে রেখেছিল বলেও সেনাবাহিনীর দাবি।

এই সাইবার কেলেঙ্কারি কেন্দ্রটি বন্ধ করার জন্য চিনের কমিউনিস্ট পার্টির সরকার মায়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর চাপ তৈরি করছিল। চিনা মাফিয়া সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত নানা অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নিতে মায়ানমার ও থাইল্যান্ডের সরকারকে নির্দেশ দিচ্ছিল চিনের কমিউনিস্ট সরকার। চলতি বছরের শুরুতে হাজারখানেক চিনা কর্মীকে এই সাইবার জালিয়াতি কম্পাউন্ড থেকে বের করে চার্টার্ড প্লেনে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল চিন। সেখানে থাইল্যান্ড থেকে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহ করা হত বলেও অভিযোগ ছিল। তা বন্ধ করার পরেই চিনা কর্মীদের ফেরানো হয়।

শুধু কে কে পার্ক তথ‍্যপ্রযুক্তি হাব নয়, মায়ানমার-থাইল্যান্ডের সীমান্তে কমপক্ষে ৩০টি এমন সাইবার জালিয়াতির কম্পাউন্ড রয়েছে। এদের বেশিরভাগই কারেন মিলিশিয়া গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং বেশিরভাগই এখনও কাজ করছে। ওই কমপ্লেক্সেগুলির ভিতরে থাকা হাজার হাজার লোক সাইবার জালিয়াতি করছে। অভিযোগ সাইবার জালিয়াতির টাকার ভাগ মায়ানমারের সেনাবাহিনীর কাছেও পৌঁছে যাচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, গত দু’বছর ধরে কেএনইউ এবং অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলি এই এলাকা দখলে রেখেছিল। তাদের এই অঞ্চল থেকে হটিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে মায়ানমার সেনার জন্য এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলির সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

মায়াওয়াদ্দিকে মায়ানমারের বাকি অংশের সঙ্গে সংযুক্তকারী প্রায় সমস্ত রাস্তা এখন সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে। ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রথম পর্যায়ের আগে এই লক্ষ‍্য ঠিক করেছিল সেনাবাহিনী। ২০১৫ সালে যখন জাতীয় যুদ্ধবিরতির পর কারেন রাজ্যে স্থায়ী শান্তির আশা ছিল তখন জাপানের আর্থিক সহযোগীতায় কেএনইউর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় একটি শহর লে কে কাও। সেই শহরটিও দখল করেছে সেনাবাহিনী। কেএনইউর জন্য এটা কে কে পার্ক দখলের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষতি। তবে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, কে কে পার্কে সাইবার জালিয়াতির কাজ চলছে এবং সম্ভবত সেনাবাহিনী গোটা কমপ্লেক্সের কেবলমাত্র একটি অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।


Share